'যার ভেতরে ভয়, সেই বাইরে ভয় পায়'- কথাটি দিয়ে লেখক বুঝিয়েছেন, যার হূদয়ে ভয় আছে সে চারদিকে শুধু ভয়ই অনুভব করে। মানবহূদয়ে সত্য না থাকলে মিথ্যা এসে বাসা বাধে। মানুষ যদি মনে সত্যকে ধারণ করতে না পারে তবে মিথ্যা তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রর্ণ-তূর্য্য’—এমনই দুর্দান্ত লাইন রচনার স্রষ্টা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেম ও দ্রোহের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি তার কাব্য ও গানে যেমন বিদ্রোহের ঝঙ্কার তুলেছিলেন, তেমনি প্রেমের মায়াজালে সবাইকে আকৃষ্টও করেছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি স্বাধীনতার কথা বলার পাশাপাশি প্রেমেও পড়েছিলেন বারবার। ভালোবেসে প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘরও বেঁধেছিলেন বহু বাধা উপেক্ষা করে। মহান এই কবিকে শুধু ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যা দিলে নিঃসন্দেহে তার মানসকে খণ্ডিত করে দেখা হবে। কারণ তিনি দ্রোহের কবি যেমন সত্য, প্রেমের কবি হিসেবেও ততটা সত্য। তার কাব্য ও গানে দ্রোহের চেতনা এসেছে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষদের জাগানোর জন্য আর চিরন্তন প্রেমের বাণীতে এসেছে শাশ্বত কালের মানবহূদয়ের আবেদন।
এই দ্রোহী চেতনার জন্য তাকেও যে কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, এমন নয়! ব্রিটিশ রোষানলে পড়ে তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে শুধু তার লেখনীর জন্য। সে সময় তার রচিত অনেক সৃষ্টি ও বই বাজেয়াপ্তও করেছিল ব্রিটিশ সরকার। মানসিক কষ্ট নিয়ে নজরুল জেলে বসেই আবার রচনা করতে থাকেন বিদ্রোহী কবিতা ও সংগীত। যার মননে ও কর্মে ছিল বিদ্রোহ, তাকে কীভাবে বিদ্রোহী রচনা থেকে বিরত রাখা যায়! তিনি লিখেছেন—‘কারার ঐ লৌহকপাট /ভেঙে ফেল কর রে লোপাট /রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী /কারার ঐ লৌহকপাট...’
নজরুলের কাব্যে রোমান্টিক কবিসত্তার সঙ্গে বিরহ-বেদনা একাত্ম হয়ে গেছে। প্রেমবিষয়ক কাব্যেও তার বিক্ষুব্ধ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাই প্রেমের বেদনায় তিনি মানবিক হয়ে উঠেছেন। প্রিয়াকে হারানোর স্মৃতির মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন হারানো প্রেমকে। তার প্রিয়া হয়েছে নিত্যকালের সঙ্গী। হূদয়ের গভীর আর্তি তার প্রেমিক-কবিসত্তাকে চিরজাগ্রত করে তুলেছে। বলগাহারা নজরুল প্রিয়াবিরহকে একটা সময় গিয়ে মেনে নিয়েছিলেন এবং পরজনমে আবার মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় লিখেছিলেন—‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয় ভুলিও মোরে হেতা ভুলিও...’
নজরুল চেয়েছিলেন তার প্রিয়ার খোঁপার বাঁধনকে উন্মুক্ত করতে। যে উন্মুক্ততায় প্রেমের কোনো সীমাবদ্ধতা থাকবে না। প্রেম হবে চিরন্তন, সার্বজনীন। প্রত্যেকে যে প্রেমের আকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত থাকে, সে উপলব্ধিও নজরুল করেছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন, ‘আমরা এই পৃথিবীতে প্রেমের পূজারী হয়ে থাকি।’মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, তাই মানুষের মহত্তম বৃত্তি প্রেমকে তিনি আত্ম-অনুভবে দীপ্ত করে তুলেছিলেন তার কাব্য ও গানে। মূলত আপন জীবনের গভীর বঞ্চনাবোধ থেকে হয়েছিলেন বিদ্রোহী আর প্রেমের ক্ষেত্রে হয়েছিলেন চিরবিরহী। তাই তার কাব্য ও গানে প্রেম ও দ্রোহী সত্তা একীভূত হয়ে গেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয় কবি।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো :
ক) মাত্রাসংখ্যা নির্দিষ্ট। অর্থাৎ প্রতিটি চরণে ৮ ও ৬ মাত্রার দুটি পর্ব মিলে ১৪টি মাত্রা থাকে।
খ) চরণের শেষে মিত্রাক্ষর, মিল বা অন্ত্যমিল থাকে না।
গ) ভাব প্রবাহমান। অর্থাৎ একটি চরণে একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করতে হবে এমন কিছু নেই।
ঘ) চরণের শুরুতে, মাঝখানে বা শেষে বাক্যের শেষ বা শুরু হতে পারে।
ঙ) প্রয়োজন মতো যতিচিহ্নের ব্যবহার করা যায়।